ছাপ্পান্নতম অধ্যায়ঃ সন্দেহ অপনোদনঃ
প্রসঙ্গঃ ইনতিকালের তারিখ সম্পর্কে ভুল ধারণার অপনোদন
============
আহলে হাদীস বা লা-মাযহাবীদের নেতা মাওলানা আকরাম খাঁ, ওহাবী ও মউদূদী পন্থীসহ ঈদে মিলাদুন্নবী বিরোধীরা নবী করিম [ﷺ]-এঁর ইনতিকালের তারিখ নিয়ে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে প্রতি বৎসর পেপার পত্রিকায় প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের অবশ্যই জানা থাকার কথা যে, কোন একটি বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা ও মতামত থাকলেও নির্ভরযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্ত অবশ্যই আছে। অনুসন্ধান করে সেটা বের করা এবং সে অনুযায়ী আমল করাই ঈমানদারের কাজ এবং মানুষকেও ঐ সত্যটি অবগত করানো উচিত। কিন্তু তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সন্দেহের সৃষ্টি করে রাখে - কিতাবের বর্ণনা অনুযায়ী সঠিক ফয়সালাটি তারা বলেনা। তাদের কেউ বলে, রবিউল আউয়াল মাসের ২ তারিখে নবী করিম [ﷺ] ইনতিকাল করেছেন। কেউ কেউ বলেন, ৮ তারিখ। কেউ বলে, ৯ তারিখ। কেউ বলে, ১০ তারিখ। কিন্তু ১২ই রবিউল আউয়ালের বর্ণনাটি যে সঠিক এবং অধিকাংশের মত, এ কথাটা তারা গোপন রাখে।
তাই আমি পাঠকদের খেদমতে ইবনে কাছির প্রণীত আল-বিদায়া ওয়ান-নেহায়া গ্রন্থের ৫ম খন্ড পৃষ্ঠা ২৫৪-২৫৬ হতে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি পেশ করলাম- যেন তারা আপন গুরুর কথা মানে। ইমাম আহমত রেযা (رحمة الله عليه) এর ফতোয়াও এতদসঙ্গে উল্লেখ করা হলো।
ইবনে কাছির (মৃত্যু ৭৭৪ হিজরী) বলেন - “ইবনে ইসহাক ও ওয়াকেদীর বিশুদ্ধ বর্ণনামতে নবী করিম [ﷺ] ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখ সোমবার দিন ইনতেকাল করেছেন।” উক্তিটি নিম্নরূপঃ
توفى رسول الله صلى الله عليه وسلم لاتنتي عشرة ليلة خلت من شهر ربيع الاول فى اليوم الذي قدم فيه المد ينة مها جرا ـ
অর্থ- ”নবী করিম [ﷺ] ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে সোমবার দিনে ইনতেকাল করেন- যে দিনে তিনি হিজরত করে মদিনায় প্রবেশ করেছিলেন” (বেদায়া-নেহায়া ৫ম খন্ড ২৫৫ পৃষ্ঠা)। এরপর ইবনে কাসির মন্তব্য করেনঃ-
والمشهور قول ابن اسحاق والوا قدى ورواه الواقدى عن ابن عباس عن عاإشة رضي الله عنها وعن عروة عن عاإشة قالا توفى رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم الا ثنين لثنتى عشرة ليلة خلت من ربيع الا ول ورواه ابن اسحاق عن عبد الله بن ابى بكر بن حزم عن ابيه مثله ـ وزاد ودفن ليلة الاربعاء ـ
অর্থ- “নবী করিম [ﷺ]-এঁর ইনতেকালের তারিখের বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে ইবনে ইসহাক ও ওয়াকিদীর বর্ণনাই প্রসিদ্ধ ও মশহুর। ওয়াকেদী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এবং ওরওয়া ইবনে যুবাইর (رضي الله عنه)-এঁর সূত্রে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) থেকে রেওয়ায়াত করেন- তাঁরা উভয়ে বলেন- “রাসূল কারিম [ﷺ] ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে বেছালপ্রাপ্ত হন। ইবনে ইসহাক আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর ইবনে হজম সূত্রে উপরোক্ত রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় অতিরিক্ত এই কথাটি ছিল- “এবং মঙ্গলবার দিবাগত বুধবার রাত্রে নবী করিম [ﷺ]-কে দাফন করা হয়” (বেদায়া নেহায়া ৫ম খন্ড ২৫৫-২৫৬ পৃষ্ঠা)।
ইনতিকাল তারিখ নির্ধারণে মতভেদের প্রকৃত কারণঃ
ইবনে কাছির বলেন- নবী করিম [ﷺ]-এঁর ইনতেকালের তারিখ নিয়ে বিভিন্ন মতের কারণ হলো - চন্দ্র দর্শনের হিসাব নিয়ে গোলমাল। কেননা, প্রথম চন্দ্র দর্শনের তারিখটি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হয়। মক্কা শরীফ ও মদিনা শরীফেও কোন কোন সময় ১ দিনের ব্যবধান হয়ে যায়। পূর্বাঞ্চলে ২ দিনের ব্যবধানও লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং মদিনা শরীফের চাঁদের হিসাবটিই এই ক্ষেত্রে মানদন্ড ধরে নিলে কোন সমস্যা থাকে না। সব হিসাব মিলে যাবে। সে মতে ১০ম হিজরীর শেষ মাস যিলহজ্ব চাঁদের ১লা তারিখ মদিনাবাসীগণ শুক্রবার থেকে গণনা করেন। কিন্তু মক্কাবাসীগণ আগের দিন বৃহস্পতিবার থেকে গণনা করে ৯ তারিখ শুক্রবার হজ্বের দিন ধার্য্য করেন - অথচ সেদিন মদিনা শরীফে ছিল, চাঁদের ৮ তারিখ। মক্কা মদিনার দূরত্ব ৫০০ কিঃ মিঃ। সুতারং চন্দ্র দর্শন বেশকম হতে পারে।
সে মতে এ মাস থেকে পূর্ববর্তী ৩ মাস মদিনায় একাধারে ৩০ দিনে পূর্ণ হয়। সে হিসেবে মহররম মাসের ১লা তারিখ মদিনা শরীফে ছিল রবিবার। পরবর্তী সফর মাসের ১লা তারিখ ছিল মঙ্গলবার। তার পরবর্তী মাস রবিউল আউয়ালের ১লা তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার এবং ১২ তারিখ ছিল সোমবার। সুতরাং নবী করিম [ﷺ]-এঁর ইনতেকাল তারিখটি ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার। (বেদায়া নেহায়া ৫ম খন্ড পৃষ্ঠা ২৫৬) ওয়াকেদীর ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকলেও ইবনে ইছহাকের ব্যাপারে কারো কোন আপত্তি নেই। সুতরাং উপরের রেওয়াতটি বিশুদ্ধ।
আর একটি সহীহ বর্ণনা দেখুনঃ
عن عفان عن سعيد بن مينا عن جابر وابن عباس أنهما قالا : ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم عام الفيل يوم الاثنين الثاني عشر من شهر ربيع الأول ـ وفيه بعث ـ وفيه حاجرـ وفيه مات . وهذا هوا لمشهور (البد اية والنهايةج ٢ صفحة ٢٦)
অর্থ- “হযরত জাবের (رضي الله عنه) ও হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে সায়ীদ ইবনে মীনা সূত্রে আফফান বর্ণনা করেছেন-জাবের ও ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেনঃ ”নবী করিম [ﷺ] হস্তীসনের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার দিন ভূমিষ্ট হয়েছেন। ঐ ১২ তারিখে এবং ঐ সোমবার দিনেই তিনি নবুয়তের দায়িত্ব লাভ করেছেন, হিজরত করেছেন ও ইনতেকাল করেছেন। এটাই প্রসিদ্ধ বর্ণনা।” (বেদায়া ২য় খন্ড ২৬০ পৃষ্ঠা)।
৭৭৪ হিজরী সনের পূর্বেই ইবনে কাছির তাঁর গ্রন্থে নবী করিম [ﷺ]-এঁর জন্ম ও ইনতিকালের তারিখ এবং দিনক্ষণের সুষ্ঠু সমাধান দেয়ার পর বর্তমানকালের স্বঘোষিত পন্ডিতগণ বিভ্রান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করায় তাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে কারো কষ্ট হবার কথা নয়। আল্লাহ বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের সুমতি দান করুন। তাদের মতেই ইবনে ইসহাক ও মীনা নির্ভরযোগ্য রাবী। সেজন্যই তাঁদের উদ্ধৃতি পেশ করলাম।
ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله عليه)-এঁর ফতোয়াঃ
ইমাম আহমদ রেযা (رحمة الله عليه) তাঁর (নুৎকুল হিলাল) গ্রন্থে ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার হুযুর [ﷺ]-এঁর বেছাল শরীফের তারিখটি আটটি দলিল দ্বারা প্রমাণ করেছেন। তার মধ্যে তাবাকাতে ইবনে সা’আদ সূত্রে হযরত আলী (رضي الله عنه) এর রেওয়ায়াত, যারকানী শরীফ সূত্রে ইবনে ইসহাক এর রেওয়াআত, আল্লামা দিয়ার বিকরীর তারিখুল খামিছ সূত্রে দুইটি রেওয়ায়াত, যারকানী শরীফে জমহুর উলামা সূত্রে অন্য একটি রেওয়াআত, ইমাম আবু হাতেম রাযী, ইমাম রাযীন আবদারী ও ইমাম ইবনে যাওজীর কিতাবুল ওয়াফী সূত্রে, ইমাম ইবনে জাযরীর কামিল গ্রন্থ সূত্রে, মাজমাউল বিহারিল আনওয়ার সূত্রে এবং ফাযেল মুহাম্মদ সাব্বাব কৃত আছআফুর রাগিবীন গ্রন্থ সূত্রে - সর্বমোট আটটি রেওয়ায়াত অতি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। রাবীগণের মধ্যে হযরত আলী, হযরত আয়েশা, ছাআদ, উরওয়া, ইবনে মুসাইয়িব, ইবনে শিহাব, আফফান, ছায়ীদ, ইবনে মিনা, জাবের, ইবনে আব্বাস, ইবনে ইসহাক-প্রমুখ রাবীগণ একবাক্যে বলেছেন- ১২ তারিখ সোমবার হুযুর [ﷺ]-এঁর ওফাত তারিখ।
হুযুরের পরিবারবর্গের রেওয়ায়াতকে পাশ কাটিয়ে অন্যের দুর্বল রেওয়ায়াত গ্রহণ করে একটি প্রতিষ্ঠিত বিষয় বিতর্ক সৃষ্টি করা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আ’লা হযরত ইমাম আহম্মদ রেযা (رحمة الله عليه) এর গবেষণামূলক ফতোয়া আমার মাসিক পত্রিকা সুন্নীবার্তা ৫৯ নম্বরে ছাপা হয়েছে। সেখানে বিস্তারিত দলীল ও হিসাব বর্ণনা করা হয়েছে। গবেষকগণের জন্য এটি অতি মূল্যবান তথ্য।
No comments: