জঙ্গে মূতা বা মূতার যুদ্ধঃ
প্রসঙ্গঃ তিনজন সেনাপতির শাহাদাতের অগ্রিম ইঙ্গিত, মদিনা শরীফ থেকে সুদূর মূতা দর্শন, গায়েবী সালামের জবাব দান, জানাজার পর দোয়াঃ
==========
মূতা সৌদী আরব সংলগ্ন জর্দানের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত শহর। নবী করীম [ﷺ] ইসলামের দাওয়াতপত্র দিয়ে ৭ম হিজরীতে বুছরা অঞ্চলের গাসসানী শাসকের নিকট হারেছ ইবনে ওমাইর (رضي الله عنه) নামক সাহাবীকে দূত হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন। দূত মূতা নামক স্থানে পৌঁছলে শাসক সুরাহ্বিল ইঁবনে আমর গাসসানী তাঁকে শহীদ করে ফেলে। এর পূর্বে নবী করীম [ﷺ] কর্তৃক প্রেরিত কোন দূত শহীদ হননি।
এই সংবাদে নবী করীম [ﷺ] ৮ম হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসে তাঁর পালিত পুত্র হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه)-এর অধীনে তিন হাজার সাহাবীকে গাসসানী শাসক সুরাহ বিল-এঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করার সময়ই নবী করীম [ﷺ] তিনজন সেনাপতির শাহাদাতবরণের অগ্রিম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি এরশাদ করলেন, “যদি তোমাদের আমীর যায়েদ ইবনে হারেছা শহীদ হন, তাহলে পরবর্তী আমীর হবেন জাফর ইবনে আবু তালেব। তিনিও শহীদ হলে তোমাদের আমীর হবেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তিনিও শহীদ হলে তোমাদের মধ্য হতে যেকোন একজনকে আমীর বানিয়ে নিবে।”
এ বলেই তিনি সৈন্য বাহিনী রওনা করে দিলেন এবং নিজে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে তাদেরকে বিদায় দিয়ে বললেন, “প্রথমে মূতাবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দিবে। কবুল না করলে যুদ্ধ করবে।”
এ খবর পেয়ে সুরাহবিল, একলক্ষ সৈন্য সংগ্রহ করলো। রোমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াস একলক্ষ সৈন্য নিয়ে বালকা নামক স্থানে সুরাহবিলের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসলো। একদিকে তিন হাজার, অপর দিকে দুইলক্ষ সৈন্যের মধ্যে অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা প্রথমে শহীদ হয়ে গেলেন। নবীজীর ইলমে গায়েব বাস্তবে পরিণত হলো। এরপর সেনাপতির দায়িত্ব নিলেন হযরত জাফর (رضي الله عنه) প্রথমে তাঁর ডানহাত শহীদ হলো। বামহাতে তিনি পতাকা তুলে ধরলেন। এবার তাঁর বাম হাতও শত্রুর তরবারীর আঘাতে শহীদ হলো। এবার তিনি পতাকা মুখে কামড় দিয়ে বুকে ধারণ করলেন। শত্রুরা তাঁকে শহীদ করে ফেললো। তাঁর শরীরের সম্মুখভাগেই ৭২টি বর্শা ও তীরের আঘাত লেগেছিল।
যখন তিনি শহীদ হয়ে গেলেন- তখন নবী করীম [ﷺ] মদিনা শরীফের মসজিদে নববীতে বসে বসে সব কিছুই দেখতে পেলেন। তিনি হঠাৎ করে গায়েবী সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘ওয়া আলাইকুমুছ সালাম’। উপস্থিত সাহাবাগণ কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করলেন,
انى أسمع ما لا تسمعون وأنى أرى ما لا ترون (بخارى شريف)
অর্থাৎঃ “তোমরা যাহা শুননা - আমি তাহা শুনি; তোমরা যাহা দেখনা - আমি তাহা দেখি” (বুখারী)। আমি দেখতে পাচ্ছি - আল্লাহ পাক জাফরকে দুহাতের বদলে দুটি নূরের বাহু দান করেছেন। তিনি ফেরেশতাসহ আকাশপথে উড়ে যাচ্ছেন - আর আমাকে এভাবে আখেরী সালাম দিচ্ছেন - “আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ।” তাই আমি তাঁর সালামের জবাব দিচ্ছি।” সুবহানাল্লাহ! নবী প্রেমিকদেরকে আল্লাহ এমনিভাবেই সম্মানিত করে থাকেন। [ নবীজী জমিনে - কিন্তু তাঁর দৃষ্টি আকাশে।]
যুদ্ধে হযরত জাফর (رضي الله عنه) শহীদ হওয়ার পর হুযুরের পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (رضي الله عنه) সেনাপতিত্ব গ্রহণ করলেন। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে তিনিও শহীদ হয়ে গেলেন। এবার সাহাবাগণ নবী করীম [ﷺ]-এঁর পূর্বনির্দেশ মোতাবেক পরার্মশ করে খালেদ ইবনে ওয়ালিদকে সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। হযরত খালেদ বীরবিক্রমে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অসংখ্য শত্রুকে তিনি নিধন করে চললেন। শত্রুরা পলায়ন করলো। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাতে মুসলমানদের বিজয় দান করলেন। বিপুল গণিমতের মাল নিয়ে হযরত খালেদ (رضي الله عنه) মদিনায় প্রত্যার্বতন করলেন।
জঙ্গে মূতার যুদ্ধ পরিস্থিতির আগাম সংবাদ প্রদান করে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়েব প্রমাণ করে দিয়েছেন। তারপর হযরত জাফর (رضي الله عنه) আকাশ পথে নূরের পাখার ভর করে ফেরেশতাসহ যাওয়ার পথে নবী করীম [ﷺ] ছালাম প্রদান করা এবং নবী করীম [ﷺ] তাঁকে শূন্যলোকে দেখা - এসবই গায়েবী জিনিস। কোন সাহাবীই এ ঘটনা দেখেননি। কিন্তু নবীজীর কথায় তাঁরা বিশ্বাস করেছেন। নবীজীর ইলমে গায়েব চাক্ষুস না দেখেও সাহাবীগণ বিশ্বাস করতেন। কিন্তু আলেম নামধারী ভ্রান্ত কিছু লোক আজকাল নবীজীর ইলমে গায়েবকে অস্বীকার করে চলছে এবং লেখনির মাধ্যমে মানুষকে গোমরাহ করছে।
বোখারী শরীফের উদ্ধৃত হাদিসখানায় (মা) শব্দটি দুবার ব্যবহার করা হয়েছে। যার মর্মার্থ দাঁড়ায় - সাহাবাগণের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির বাইরে যা কিছু আছে - নবী করীম [ﷺ] তার সবকিছ্ইু দেখেন ও শুনেন। বস্তুতঃ মানুষের শ্রবণ ও দৃষ্টির অগোচরের সবকিছুই নবী করীম [ﷺ]-এঁর শ্রবণ ও দৃষ্টিসীমার আওতায় রয়েছে। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও আকল বহির্ভূত বস্তুকেই গায়েব বলা হয় এবং এ বিষয়ে অবগতির নামই ইলমে গায়েব। নবীজীর এই ইলমে গায়েব আল্লাহ প্রদত্ত।
জানাজার দোয়াঃ
জঙ্গে মূতায় তিনজন শহীদ সিপাহসালারের জানাজা নামায মদিনা শরীফে নবী করীম [ﷺ] সঙ্গে সঙ্গে আদায় করেছিলেন এবং ছালাম ফিরিয়ে দোয়াও করেছিলেন। বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থের ৪র্থ খন্ড ২৪৩ পৃষ্টায় নবীজীর দোয়ার কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-
فصلى عليه (زيد) رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال استغفروا له فقد دخل الجنة وهو شهيد ...... فصلى عليه (جعفر) رسول الله صلى الله عليه وسلم وقال استغفروا لأخيكم فإنه شهيد دخل الجنة وهو يطير في الجنة
অর্থ- “হযরত যায়েদ ইবনে হারেছা (رضي الله عنه) মূতায় শাহাদাতবরণ করার পর নবীজী মদিনা শরীফে তাঁর জানাযা নামায পড়ে সাহাবাগণকে বললেন - তোমাদের ভাই যায়েদ ইবনে হারেছার জন্য দোয়া কর - সে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। হযরত জাফর শহীদ হলে হুজুর [ﷺ], মদিনা শরীফে তাঁর জানাযা নামায পড়ালেন এবং সাহাবাগণকে বললেন - তোমাদের ভাই জাফরের জন্য দোয়া করো। কনেনা, সে শহীদ হয়ে জান্নাতে উঁড়ে বেড়াচ্ছে।” (বেদায়া নেছায়া ও ফতরুল ক্বাদীর)। প্রমাণ স্বরূপ দেখুন আমার লিখিত পুস্তক “ফতোয়ায়ে ছালাছা।” জানাযা নামাযের পর দোয়া ও মুনাজাত সম্পর্কে হাদীস থেকে ৭টি দলিল তাতে পেশ করা হয়েছে। জানাযা হলো ফরজ নামায। ফরয নামাযের পর যে দোয়া করা হয় - তা শীঘ্র কবুল হয়। উক্ত কিতাবে মোনাজাত বিরোধীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হয়েছে।
No comments: